তো এবার কোলকাতা থেকে শাশুড়ি আসায় ঠিক হলো এবার সিডনির অপেরা হাউজ দেখবো। মেলবোর্ন থেকে গাড়ি করে গেলে লাগবে ৮ ঘন্টা। ড্রাইভ করতে করতে ঘুম চলে আসে। আর যে ড্রাইভ করে তার দেখার কিছু থাকে না। বউর সাথে গাঁইগুঁই করে প্লেনে যাবার কথা ঠিক হয়ে গেলো।
ব্যাগ গুছিয়ে পরের দিন সকাল সাতটায় রওনা দিলাম মেলবোর্নের টুলামারিন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। সব মিলিয়ে আড়াই ঘন্টায় সিডনির হোটেল রেডিসনে পৌঁছে গেলাম। হোটেলের চমৎকার অবস্থান। আধা ঘন্টা হাঁটলেই অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রিজ। রিশিপশন থেকে একটা ম্যাপ ও পর্যটন গাইড বই নিয়ে নিলাম।
অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া পুরোপুরি বাংলাদেশের বিপরীত। বাংলাদেশে যদি শীত থাকে, এখানে গরম। আর বাংলাদেশে গরম থাকলে এখানে তীব্র শীত। আমরা যখন যাই, অস্ট্রেলিয়ায় তখন গ্রীষ্মকাল। তাই নাস্তা শেষ করে পাতলা একটা টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট আর দৌঁড়ানোর জুতা পরেই হাঁটিহাটি পা পা করে পৌঁছে গেলাম অপেরা হাউজ।
পাহাড়ি এলাকা বলে এখানকার পথঘাট ও অবস্থান বেশ উঁচু-নিচু। চারপাশে মানুষজনের ছুটোছুটি আর ব্যস্ততা হলেও তাদের রয়েছে এক অদ্ভূত শৃঙ্খলা বোধ। কিন্তু মেলবোর্নে সাত বছর ধরে থাকি বলে সিডনিকে আমার বেশ ব্যাস্ত মনে হলো। অবশ্য ঢাকা থেকে যে কেউ সরাসরি সিডনিতে আসলে, তার সিডনিই ভালো লাগবে। ভালো লাগবে এখানের দিনের ও রাতের ব্যস্ততাকে। মেলবোর্নে সন্ধ্যা সাতটার দিকেই আবাসিক এলাকাগুলো চুপচাপ হয়ে যায়। মানুষ ঘুমাতে চলে যায় রাত আটটার মধ্যে। সিডনিকে দেখলাম তার উল্টো। তার বারোটার সময়ও হইহোল্লা শুনেছি হোটেল থেকে।
সিডনিতে যানযট ঢাকার মতো না হলেও, কম যায় না। সিডনি স্থায়ী না হওয়ার পেছনে, এটা আমার অন্যতম কারন। হয়তো সেই জন্যই এখানে দুই চাকার বাহন বেশি প্রিয়। শুধু তাই নয়, মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা করে এখানে পার্কিংয়ের জায়গা দেখলাম। গরমে সাইকেল চালাতে আলাদা মজা।
অপেরা হাউজ দেখতে মনে হয় অনেকগুলো নৌকার পাল একসাথে বসানো হয়েছে। পুরো দুনিয়া থেকে অগুনিত মানুষ আসে দেখতে। কেউ একজন বলেছিলেন, “অসাধারণ স্থাপত্যে নির্মিত হাউজটি দেখলে মনে হয় পানির ওপর ভাসমান কয়েকটি নৌকার সফেদ পাল। আবার মনে হতে পারে শ্বেতশুভ্র বিশাল রাজহাঁসের ঝাঁক!” তেইশ তলা সমান উঁচু এই অপূর্ব ভবনটিতে দুই হাজার ছয়শ নব্বইটি আসনসহ একটি কনসার্ট হল, একটি ড্রামা থিয়েটার ও একটি প্লে-হাউজ রয়েছে। বাইরের চত্বরটিও বিস্তৃত ও সুদৃশ্য।
জন আডজেন নামের এক ড্যানিশ ভদ্রলোক এর নকশা করেন। ভবনটির আসল কৌশলই এর স্থাত্যকলায়। এই অপেরা হাউজটি এক সময় ম্যাককুইরি বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৮১৭ সালে বন্দরটি তৈরি হয়। এখানে ট্রামের রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য ছোটখাটো কারখানা তৈরি করা হয়েছিলো সেই সময়। এরপর ১৯৫৯ সালে এখনকার অপেরা হাউজ তৈরি শুরু হয়।
এখানে দাঁড়িয়ে হারবার ব্রিজ দেখা যায়। একটার শীর্ষবিন্দুতে দাঁড়িয়ে অন্যটাকে দেখতে অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিলো। পড়েছিলাম, জন মারা গিয়েছিলেন অভিমান বুকে নিয়ে। নিজের সৃষ্টিকে এক বারের জন্যও স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেও পারেননি। নিজের সৃষ্টি থেকে বহু দূরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে।
এই ভবনে আছে সাতটি প্রক্ষাগৃহ। এখানে বছরে গড়ে দেড় হাজার অনুষ্ঠান হয়। ভেতরে গিয়ে দেখলাম মানুষের লম্বা লাইন। সবাই টিকেট কিনছেন কোন না কোন অনুষ্ঠানের জন্য।
অপেরা হাউজ থেকে চলে যাই মাদাম তুসো’র ওখানে। মাদাম ম্যারি তুসো নামের এক ফরাসী মহিলা প্রথম প্রচলন শুরু করেছিলেন মোমের মুর্তির প্রদর্শনী। ১৮৩৫ সালে তিনি লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে মোমের এই জাদুঘরটি স্থাপন করেছিলেন। পরে সেটা মাদাম তুসোর জাদুঘর নামে পরিচিতি পায়। সিডনিতে তারই একটা রয়েছে। এখানে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, তারকা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খ্যাতনামা খুনী ব্যক্তিদের মূর্তিও সযত্নে রক্ষিত আছে। দেখলাম ইংল্যান্ডের রাজ পরিবার থেকে ভারতের মহাত্মা গান্ধীর মানব আকারের পুতুল। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, সত্যিই কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। মুর্তিগুলো যেন মানুষয়ের সাথেই মিশে আছে। কতবার যে মোমের সাথে ধাক্কা খেয়ে “দুঃখিত” বলতে গিয়ে দেখি আসল মানুষ নয়, তার ইয়াত্তা নেই!
এরপর চলে গেলাম, এ্যকুরিয়াম দেখতে। বিশাল ভবনটির ভেতরে সব কাঁচের দেয়াল। টিকেট কেটে ভেতরে গিয়ে দেখলাম সিঁড়ি নিচে চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘরে পৌঁছলাম, যেটা মূলতঃ কাঁচের তৈরি। চারিদিকে নীল পানি। মাছেরা সাঁতার কেঁটে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে একটা বিশাল স্টিংরে চলে যাওয়ায় আঁতকে উঠলাম। কিছুক্ষন পরে একটা হাতুড়ি মাথা হাঙ্গর আসলো। মনে হলো আমাকে অনেক্ষন দেখলো। কাঁচের দেয়ালের পাশ থেকে কামড় দেয়া যাবে না বলে হয়তো মন খারাপ করে চলে গেলো। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তিনদিন ছিলাম সিডনিতে। কিন্তু মনে হলো, তিনদিন যথেস্ঠ সময় না। সিডনি ঠিকমতো দেখতে হলে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় নিয়ে আসা উচিত। মেলবোর্ন ফেরত যাওয়া কালে প্লেনে উঠতে যাওয়ার সময় মনে হলো একটা ছবি তুলে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখি। যেই না ফোন বের করে ছবি তুলতে যাবো, বিমানরক্ষীরা হা হা করে আসলো। জানিয়ে দিলো বিমানের কাছ থেকে ছবি তোলা মহা অপরাধ। ৫০০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পরে। অতএব, বিমানের কাছ থেকে ছবি তোলা বা মোবাইল ব্যবহার করা কখনোই নয়!